হাফিজুর রহমান লাভলু, শেরপুর প্রতিনিধি: সংস্কার, সঠিক পরিচর্যা ও দেখভালের অভাবে দখল হয়ে যাওয়া শেরপুর পৌর এলাকার পানি নিস্কাশনে ব্যবহৃত খালগুলোর প্রাণ যায় যায় অবস্থা। ফলে অল্প বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায় শহরের বিভিন্ন রাস্তাঘাট, ঘর-বাড়ীতে ঢুকে হুহু করে পানি। তাই জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষা পেতে খালগুলো সংস্কার ও সঠিক পরিচর্যার দাবি নাগরিকদের। এদিকে, দ্রুতই খালগুলোকে দখলমুক্ত করে পরিকল্পিত উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে পৌরসভা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ময়লা-আবর্জনা, সঠিক পরিচর্যার অভাব আর দখলদারদের কারণে ভরাট হয়ে গেছে শেরপুর পৌর এলাকার পানি নিস্কাশনের খালগুলো। যার কারণে অল্প বৃষ্টিতে এভাবেই শেরপুর পৌর শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা-ঘাট তলিয়ে যায়, আর হু হু করে ঘর-বাড়ীতে পানি ঢুকে। দীর্ঘক্ষণ পানিতে তলিয়ে থাকায় সড়কের বিটুমিন উঠে গিয়ে সৃষ্টি হয় খানা-খন্দের। পৌর শহরের চাপাতলী ও আমনকুড়া খাল দিয়ে শহরের সিংহভাগ মহল্লার পানি নিস্কাসন হওয়ার কথা থাকলেও বছরের পর বছর দখলদারদের কবলে পরে ২০ থেকে ৪০ফুট প্রস্থের খাল দু’টি সরু নালায় পরিণত হয়েছে। শুধু তাই নয়, বাসা-বাড়ী থেকে সুয়ারেজের সংযোগ দেয়ায় নোংরা পানি দূর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এতে নানান রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছেন বাসিন্দারা।
সম্প্রতি সরেজমিনে চাপাতলী খালে গিয়ে দেখা যায়, খাল দু’পাশে মাটি কেটে কেটে ছোট করা হয়েছে খালটি। খালের পানি অনেক কালো দেখা গেছে। কয়েক জায়গায় সুয়ারেজের সংযোগ দেয়া। কয়েকস্থানে দেখা গেছে, পানিতে ময়লা-আবর্জনার স্তুপ হয়েছে। পানিতে অনেক প্লাস্টিকের ব্যাগ, প্লাস্টিকের বোতল ভেসে আছে।
স্থানীয়রা জানান, খালটি সংস্কার করা প্রয়োজন। বার বার পৌর মেয়রকে বলা হয়েছে সংস্কারের জন্য। পৌরসভা থেকে মাটি খুঁড়ে সাইডে রাখে, বৃষ্টি হলেই সেই মাটি আবার পানিতে পড়ে যায়। আমাদের দাবি হচ্ছে, দ্রুত সময়ের মধ্যেই খাল দখলমুক্ত করে পরিকল্পিত নগরায়ন করা হোক।
চাপাতলী এলাকার বাসিন্দা আরমান বলেন, ‘শুনেছি এই খালটা আগে বড় ছিল, পানি প্রবাহ স্বাভাবিকভাবে হয়েছে। পানি চলাচলে কোন বাঁধা সৃষ্টি হয়নি। এখন ছোট হতে হতে একেবারেই ছোট হয়ে গেছে। বর্তমানে বিভিন্ন ময়লা-আবর্জনা আটকে থাকে এবং পরিবেশে দূর্গন্ধ ছড়ায়। এই এলাকার অনেক শিক্ষার্থীরা আছে তারা দূর্গন্ধযুক্ত সড়কে চলাচল করতে অনেক সমস্যা পোহাতে হয়।’
হাবিব মিয়া বলেন, ‘এই খালটা আগে পাশে বড় ছিল। এখন দিন দিন ভরাট হয়ে খালটা চিপা হয়ে যাইতেছে। এখানে অনেক লোকজন আসে, ছবি-ভিডিও করে নিয়ে যায়, কিন্তু কোন কাজ-কাম কিছুই হয় না। দেখা যায় বর্ষাকাল আসলে পানি বাইর হওয়ার জন্য অনেক কষ্ট হয়ে যায়। পৌরসভা থেকে লাখ লাখ টাকা খরচ করে নিস্কাশনের জন্য ভেকু দিয়ে মাটি খোদাই করে। যে মাটিগুলো রাখে দেখা যায় বৃষ্টি আসলে সেগুলো এই মাটিগুলো আবার ধুঁয়ে খালেই পড়ে যায়।’
স্থানীয় বাসিন্দা করিম মিয়া বলেন, ‘আমার চোখে দেখা এই খালডা আগে মেলা বড় আছিলো। আমরা কত মাছ মারছি এইখানে। আর এখন ছোড হইতে হইতে এমনই ছোড হইছে, দেখেন কিবা হইছে। আশপাশের মেলা মানুষ পায়খানার লাইন দিছে এই খালে, এজন্য গন্ধ করে বেশি। এই খালডা বড় করলে খুব সুবিধা হবো। পানি জমবো না বাড়ি-ঘরে। হুরুত কইরি পানি খালের মধ্যে যাবো গা। খাল বড় হইলে মাছ-টাছ আবো, এলাকার মানুষ মাছ-টাছ মাইরে খাইতে পারবো।’
শহরের গৃদ্দানারায়ণপুর এলাকা বাসিন্দা সোহেল মিয়া বলেন, ‘আমনকুড়া খালটা আগে অনেক বড় ছিল। শহরের এইপাশের সব পানি এই খাল দিয়ে বের হয়ে গেছে। এখন খাল আর খাল নাই ছোট একটা ড্রেন হয়েছে। যার কারণে একটু বৃষ্টি হলেই শহরে পানি জমে থাকে। পানি জমবে এটা স্বাভাবিক। কারণ, শহরের পানি বের হবে কোন পাশ দিয়ে। এজন্য শহরে পানি জমে।’
আরেক বাসিন্দা লাভলু মিয়া বলেন, ‘আরো কয়েকবার শুনেছি এই খালটা সংস্কার করবে পৌরসভা থেকে। কিন্তু সংষ্কার আর করে না। আমরা চাই, দ্রুত সময়ের মধ্যে খালটি খনন করে সংস্কার করুক। তাতে, আমাদের সকলের জন্য লাভ হবে। আর যদি সংস্কার না করে তাহলে শহরে জলাবদ্ধতা কোনভাবেই কমবে না।’
নাগরিক প্লাটফর্ম জনউদ্যোগের আহবায়ক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘পৌর শহরের পানি নিস্কাশনের প্রধানধারা আমনকুড়া খাল ও চাপাতলী খাল। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এই দু’টি খাল বিভিন্ন কারণে দখল-দূষণের শিকার। ফলে অল্প বৃষ্টিতেই আমাদের শহরে জলমগ্নতার সৃষ্টি হয়। এই দুইটি খাল উদ্ধার, সংস্কার এবং পানি নিস্কাশনের সু-ব্যবস্থা করতে পারলে শহরের পানি সহজেই বাইরে যেতে পারবে।’
শেরপুর পৌরসভার ২নং ওয়ার্ড সাবেক কাউন্সিলর ও ভারপ্রাপ্ত মেয়র হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আমরা একটি প্রকল্প পেয়েছি, সেটার নাম সিআরডিপি। অন্যান্য প্রকল্পে যেভাবে রাস্তা এবং ড্রেনের ওপর জোর দেয়া হয়; এই প্রকল্পে খালগুলো সংস্কার করে এটাকে ব্যবহারের উপযোগী করার জোর দেয়া হয়েছে। শুধুমাত্র একটি রাস্তা এই প্রকল্পে অন্তর্ভূক্ত আছে। সবগুলো খালই এই প্রকল্পে অন্তর্ভূক্ত আছে, তারমধ্যে অন্যতম হচ্ছে চাপাতলী ও আমনকুড়া খাল। আমরা আশা করছি, আগামী জানুয়ারি মাসে আমরা টেন্ডারে যেতে পারবে। ইতোমধ্যেই এই প্রকল্পটি একনেকে পাশ হয়েছে সিআরডিপি ২য় পর্যায়ে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা প্রায় ৪০কোটি টাকা বরাদ্দ পাবো এই প্রকল্প থেকে এবং সেই প্রকল্পে প্রধানত কাজ হবে চাপাতলী ও আমনকুড়া খালসহ অন্যান্য খালকে সংস্কার করা, পাড় বাঁধাই করা এবং দৃষ্টিনন্দন একটি ওয়াকওকে করা। যে ওয়াকওয়ের মাধ্যমে সকাল বেলা লোকজন বা সন্ধ্যা বেলা লোকজন হাটাহাটি করতে পারবে। একইসাথে সেই ওয়াকওয়ের পাশে আমরা বৃক্ষ রোপন করে আমরা ওই এলাকাটিকে একটি পরিচ্ছন্ন ও সবুজ এলাকা হিসেবে গড়ে তোলতে চাই। আর সংস্কার কাজ শেষ হলে অন্তত ১৫টি মহল্লার মানুষ জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।’