ইলেকট্রনিক বর্জ্য বা ই-বর্জ্য ইংরেজী Electronic Weste বা E-Weste বলতে পরিত্যাক্ত বৈদ্যতিক সরঞ্জাম বা যন্ত্রপাতিকে বোঝায়। এগুলো মূলত আমাদের বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত বৈদ্যতিক যন্ত্রপাতি যেমন-ফ্রিজ, এসি, কম্পিউটার ল্যাপটপ, ওয়াসিং মেশিন, টিভি, ফ্যান, মোবাইল ফোন, লাইট, বাল্ব ইত্যাদিকে বোঝায়। এ সমস্ত পণ্যের যন্ত্রাংশ শুধু লোহা তামা সোনা রূপা বা প্লাষ্টিক তৈরী হয় না, এর সাথে সীসা, ক্যাডলিয়াম, বেরিলিয়াম, ক্রোমিয়াম, দস্তা এবং পারদ এর মত ক্ষতিকারক পদার্থ দিয়েও তৈরী হয়। অথচ এ সমস্ত পণ্য যখন ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে উঠে তখন এসব পণ্য আমার যত্রতত্র, যেখানে-সেখানে ফেলে দেই বা পুরানো কোন দোকানে বিক্রয় করি বা দিয়ে দেই, ফলে এ সমস্ত বর্জ্যরে ক্ষতিকারক অংশ বায়ু, পানি, মাটির সাথে মিশে আমাদের শরীরে প্রবেশ করে ব্রেন, ফুসফুস, হার্ট, লিবারে সমস্যাসহ ক্যানসারের মত মারাত্নক রোগ হতে পারে। আবার পুরনো পণ্যের দোকানের কর্মচারীরা ই-বর্জ্যগুলো যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এসব পণ্য থেকে বিভিন্ন উপকরণ লোহা তামা, সোনা, রূপা আলাদা করেনা তারা সরাসরি ঐ সকল রোগে আক্রন্ত হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে ই-বর্জ্যৈ এক হাজারেরও বেশি বিভিন্ন ধরনের বিষাক্ত পদার্থ থাকে এবং নিত্যব্যবহার্য ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলো বেশি ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এসব ডিভাইসে ব্যবহৃত ক্ষতিকর পদার্থ সমূহ ক্যান্সার ও কিডনি নষ্ট হওয়া, থাইরয়েড হরমোন বিপর্যস্ত করা সহ বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে।
এছাড়াও এগুলো ভূপৃষ্ঠস্থ ও ভূগর্ভস্থ পানির উৎস দূষণের মাধ্যমে সুপেয় পানির প্রাপ্যতাকে কঠিন করে তোলে (Sinha et al.2007 cited in Ahmed 2011)। এই উপাদানগুলোর প্রভাবে উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও বংশ বিস্তার বাধাপ্রাপ্ত হয় । বাস্তুতন্ত্রের খাদ্য শৃংখল ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং সার্বিকভাবে পরিবেশ পরিবর্তনে এগুলো ভূমিকা রাখে।
একটি সেল ফোনে প্রায় চল্লিশটি উপাদান থাকতে পারে । এরমধ্যে ২৩ শতাংশ ধাতব পদার্থ বাকি ৭৭ শতাংশ প্লাস্টিক ও সিরামিক । একটি হ্যান্ডসেটে ২৫০ মিলিগ্রাম সিলভার, ২৪ মিলিগ্রাম স্বর্ণ , ৯ মিলিগ্রাম প্যালাডিয়াম এবং ৯ গ্রাম তামা থাকে।
এছাড়া প্রতিটি মোবাইল ফোনের লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারিতে গড়ে ৩.৫ গ্রাম কোবাল্ট থাকে(UNEP & UNU 2009)। এগুলো ছাড়াও সিসা, জিংক ও আর্সেনিকের মতো ক্ষতিকর উপাদান থাকে । তাই ব্যাটারিসহ ফোনসেট উন্মুক্ত ভূমিতে ফেললে তা মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে । সেলফোনে ব্যবহৃত ক্যাডমিয়াম ছয়হাজার লিটার পর্যন্ত পানি দূষণ করতে পারে।
২০১৪ সালে জাপানে অবস্থিত জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ে “The Global E-Weste Monitor 2014, Quantities Flows and Resourees” শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে যাতে বলা হয় বিশ্বে প্রতিবছর ৪ কোটি টনের ও বেশি ই-বর্জ্য উৎপাদিত হয়, যার বেশীরভাগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনে উৎপাদিত হয়, আর বাংলাদেশে বছরে প্রায় ১০ মিলিয়ন মেট্রিকটন ই-বর্জ্য তৈরী হচ্ছে। ই-বর্জ্যকে "বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল বর্জ্য প্রবাহ" হিসেবে বিবেচনা করা হয় । ২০১৭ সালের ১৫ জানুয়ারি প্রকাশিত জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে ২০১০- ২০১৫ এই ৫ বছরে এশিয়ায় ই -বর্জ্যের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৬৩ শতাংশ। কম্বোডিয়া, চীন ,হংকং, ইন্দোনেশিয়া ,জাপান, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর ,দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান ,থাইল্যান্ড,ও ভিয়েতনাম এই ১২টি দেশে ২০১৫ সাল শেষে এই বর্জ্যের পরিমাণ ছিল ১ কোটি ২৩ লাখ টন। এর মধ্যে শুধু চীনে পাঁচ বছরে তা দ্বিগুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৬৬ লাখ ৮১ হাজার টন।
জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের (UNU) বরাত দিয়ে ২০১৯ সালের ৪ জুন The Global E-Waste Statistics Partnership "Global E-Waste problem" এর উপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বিশ্বে প্রতিবছর ৫০ মিলিয়ন টন ই-বর্জ্য উৎপাদিত হয় যা এ পর্যন্ত বিশ্বে উৎপাদিত সকল বাণিজ্যিক বিমানের ওজনের চেয়ে বেশি। ২০১৬ সালে বিশ্বে ৪৪.৭ মিলিয়ন মেট্রিক টন ই-বর্জ্য উৎপাদিত হয়েছে । যার মাত্র ২০ শতাংশ রিসাইকেল হয়েছে আর ৬৬ শতাংশ এখনো মানবজাতিকে আচ্ছাদন করে রয়েছে। Solving the E-Waste Problem (StEP) একটি প্রতিবেদনে বলছে বিশ্বের ৭০০ কোটি জনগণের প্রতিজন গড়ে বছরে ৭ কেজি করে ই-বর্জ্য সৃষ্টি করে।
এসব বর্জ্য এই পৃথিবীকে বসবাসের অনুপযোগী করে তুলছে আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কেমন পৃথিবী রেখে যাচ্ছি তা এখনই ভাবতে হবে।
ফ্রান্সের একদল গবেষক বলেছেন যে আটলান্টিক মহাসাগরে যে পরিমান ই-বর্জ্য ও প্লাষ্টিকের পণ্য ভাসমান আছে তার আয়াতন ফ্রান্সের রাষ্ট্রের সমান হবে। যেগুলো পানি বা মাটির নিচে আছে সেগুলোর বাদই রইল।
বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী W F Ogburn Zvi Social Change গ্রন্থে বলেছেন “বস্তুগত আর অবস্তুগত সংস্কৃতি যদি সমান তালে না চলে তা হলে সমাজের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়।” আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির যুগে নতুন নতুন অনেক পণ্য উৎপাদিত হয় কিন্তু এগুলো যদি আমাদের ব্যবহারে সঠিক উপায় জানা না থাকে বা অনুপযোগী পণ্য রিসাইক্লিং করার জ্ঞান না থাকে তাহলে কাংখিত উন্নয়ন সম্ভব হয় না।
কিছু উন্নত দেশ ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় উদ্যোগ নিলেও বেশিরভাগ দেশই এ বিষয়ে নিরুৎসাহিত রয়েছে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ এ বিষয়ে একটি নীতিমালা তৈরী করলেও বাস্তবায়ন হয়নি। এজন্য বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী Karl Marks বলেছেন “আধুনকি পুজিবাদী সমাজব্যবস্থায় পণ্য উৎপাদন হয় মুনাফা লাভের জন্য মানুষের কল্যাণের জন্য নয় ফলে অসম প্রতিযোগিতা শুরু হয়ং নিন্মমানের অধিক পণ্য উৎপাদন করে বাজার দখলের জন্য , যা পরবর্তীতে ই-বর্জ্য পরিণত হয়।” ই-বর্জ্য বিষয়ে আমরা এখনই সচেতন হতে হবে। যে সকল প্রতিষ্ঠান ই-পণ্য উৎপাদন করবে তারা এই শর্তে বাজারজাত করবে যে যখন ঐ সকল পণ্যগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী হবে তখন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ঐ পণ্যগুলো যেমন ফেরত নিতে হবে তেমনই তাদের উৎপাদিত পণ্যদ্ধারা কোন মানুষ বা পরিবেশের ক্ষতিহলে তার দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকেই নিতে হবে। এছাড়া সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে যেমন একটি নির্দিষ্ট জায়গায় আধুনিক ও পরিবেশগত ভাবে এগুলো বিনষ্ট করা এবং এর সাথে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে ই-বর্জ্যরে কুফল প্রচার করে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরী করতে হবে। উৎপাদনকারী প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের একটা সামাজিক দায়বদ্ধতা আছে বা ধাকা উচিত। প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষের কল্যাণে বা সামাজিক পরিবেশের উন্নয়নের জন্যই পণ্য তৈরী করে তেমনই মানুষের বা সমাজের কল্যাণের জন্যই এগুলোর সঠিক ব্যবস্থাপনা করা জরুরী বলে মনে করা হয়।
লেখক : মোঃ বিল্লাল হোসেন জুয়েল; শিক্ষক, সাংবাদিক ও গবেষক
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ মনির হোসেন কাজী
বার্তা প্রবাহ পত্রিকা (রেজিঃ নং- ডিএ-৪০৪৯)
এর একটি অনলাইন প্রকাশনা।
৩৪০/এ, দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী, ঢাকা-১২০৪।
মোবাইল : +৮৮ ০১৯ ১১৮০ ৪৫৮১
ই-মেইল : bartaprobah@yahoo.com
কপিরাইট © সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত