তাইফুর রহমান, নলছিটি (ঝালকাঠি) প্রতিনিধিঃ ঝালকাঠিতে লাগামহীন ভাবে বেড়েই চলছে নিত্য পণ্যের দাম ফলে দিশেহারা নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সাধারণ মানুষ। বাজারে কোনোভাবেই পণ্যের দামে লাগাম টানা যাচ্ছে না। হু হু করে বেড়েই চলছে। চাল থেকে শুরু করে ব্রয়লার মুরগি, ডিম, আদা-রসুন, চিনি বাড়তি দরে কিনতে হচ্ছে। এমনকি মাছ ও গরুর মাংসের দাম ক্রেতার নাগালের বাইরে চলে গেছে। শুধু তাই নয়, দাম এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, শাক-সবজিতেও হাত দেওয়া যাচ্ছে না। বাজারে শীতকালীন সবজি থাকলেও, তারপরও আগের সেই চড়া দামেই বিক্রি হচ্ছে। গত সপ্তাহের মতোই উত্তপ্ত অবস্থায় রয়েছে অধিকাংশ সবজির দাম। ফলে বিপাকে পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ।
একটানা ৪র্থ বারের মতো নতুন মেয়াদে সরকার শপথ নিয়েছে। এ সরকারের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা। নিত্যপণ্যের দাম মানুষের নাগালে আনতে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া অতীব জরুরি হয়ে পরেছে। ক্ষমতাসীন দল তাদের নির্বাচনী ইশতেহারেও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে জনগণের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন-মূল্য স্বাভাবিক করতে সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা কাজে আসছে না। বরং অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে বছরের ব্যবধানে প্রায় সব পণ্যের দাম দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ হয়েছে। কিন্তু বছরের পর বছর অসাধু ব্যবসায়ীদের ‘সিন্ডিকেট’ সক্রিয় থাকলেও কার্যকর অর্থে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে প্রতিবছরই ক্রেতাকে জিম্মি করে নিত্যপণ্যের কৃত্রিম দাম বাড়িয়ে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ওই চক্রটি। সরকারি নির্দেশনার বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করেই উচ্চমূল্যে বিক্রি হচ্ছে কাঁচাবাজারের সব পণ্য। বাজারের এই লাগামহীন পরিস্থিতিতে হাঁপিয়ে উঠছেন ক্রেতারা।
বাজার করতে আসা আব্দুর রহমান নামে এক ক্রেতা বলেন, ডিমের দাম তো বলে ১৩২ টাকা ডজন। কিন্তু যদি একটু বড় ডিম নিতে চাই তখন ১৪০ টাকা করে নিতে হয়। যেভাবে সব কিছুর দাম বাড়ছে সেভাবে তো আমাদের কারো বেতন বাড়ছে না। শুধু খরচের পরিমাণ বেড়েই চলছে।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) হিসাবে এ অঞ্চলে মোটা চাল, প্যাকেটজাত আটা, ময়দা, মসুর ও মুগ ডাল, পেঁয়াজ, রসুন, আদাসহ ৪ ধরনের মসলা ও ব্রয়লার মুরগি—এই ১৩টি পণ্যের দাম বেড়েছে। কোনো ক্ষেত্রে ২ টাকা, কোনো ক্ষেত্রে ৫০ টাকা। কিছুটা কমেছে আলু ও জিরার দাম। বাজারে গত কয়েকদিনে চালের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। জেলাসহ উপজেলার বিভিন্ন বাজারে এ চিত্র দেখা গেছে। প্রায় সব ধরনের চাল কেজিপ্রতি বেড়েছে ৫ টাকা পর্যন্ত। এছাড়া আটা-ময়দা ও ডালের দাম কেজিতে বেড়েছে ১০ টাকা। তেলের দামও লিটারপ্রতি ৪ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
চড়া দামে কিনতে হচ্ছে সব ধরনের সবজি। বাজার ঘুরে দেখা যায়, শীত মৌসুমের সব ধরনের সবজি কেজিপ্রতি ৪০ থেকে ১২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। লম্বা বেগুন ৬০ টাকা, গোল বেগুন ৬০ টাকা, শসা ৬০ টাকা, করলা ১২০ টাকা,পেঁপে ৫০ টাকা, গাজর ৪০ টাকা, মুলা, ২৫ টাকা, টমেটো ৫০ টাকা, মিষ্টিকুমড়া ৫০ টাকা, শিম. ৫০ টাকা, কাঁচামরিচ ৮০-১২০ টাকা, ধনেপাতা মোটা ২০ টাকা, ফুলকপি ৫০ টাকা, বাঁধাকপি ৩০ টাকা দরে কেজি প্রতি বিক্রি হচ্ছে।আর প্রতিটি লাউ ৭০ থেকে ১০০ টাকা।
এছাড়া রুই মাছ ৩০০ টাকা, কাতল মাছ ৩৫০ টাকা, বাগদা চিংড়ি ৮০০ মাছ টাকা, কাঁচকি মাছ ৩০০ টাকা, কই মাছ ২৪০ টাকা, পাবদা মাছ ৩৫০ টাকা, শিং মাছ ৫০০ টাকা, বোয়াল মাছ ৭৫০ টাকা, ব্রয়লার মুরগী ১৮০ টাকা, কক ৩০০ মুরগি টাকা, দেশি মুরগি ৫৫০ টাকা, গরুর মাংস ৭৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
বাজার করতে আসা আরেক ক্রেতা মো. হাবিবুর, তিনি পেশায় রিক্সা চালক। তিনি বলেন, সবকিছুর দাম যেভাবে বাড়ছে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আর চলতে পারছি না। দিন দিন খরচ বাড়ছে। যে কয়টা আয় করি তা দিয়ে সংসার চালাতে খুবই কষ্ট হয়। নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মতো। এভাবে দাম বাড়তে থাকলে খেয়েপরে বেঁচে থাকা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠবে।
মুদি দোকানের পণ্যের দামও অপরিবর্তিত রয়েছে।কেবল আলু-পেঁয়াজই না আদা-রসুনের দামও রয়েছে ঊর্ধ্বমুখী। ভারতীয় আদা ২৪০ টাকা, চায়না রসুন ১৯০-২০০, দেশি রসুন ২৪০ টাকা, মুগ ডাল ১৬০ টাকা, বুটের বড় ডাল ৭৫ টাকা, প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৭৫ টাকা, খোলা সরিষার তেল প্রতি লিটার ২৭০ টাকা, চিনি ১৪৫ টাকা, দুই কেজি প্যাকেট ময়দা ১৫০ টাকা, খোলাটা ৮০ টাকা, আটা দুই কেজির প্যাকেট ১২০টাকা, খোলাটা ৪৫ টাকা, কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
মোহাম্মাদ কাজী নামে এক ব্যবসায়ী এসেছিলেন বাজার করতে। রসুন কেনার সময় কথা হয় তার সাথে। তিনি বলেন, কয়েকদিন আগেও তো দেশি রসুন ২০০ টাকায় কিনলাম, এখন তা ২৪০ টাকা করে বলছে। এভাবে হলে আমরা কোথায় যাব? কি খাবো? এতে সাধারণ মানুষের জীবন চালানো আরও দায় হয়ে পড়েছে। ফলে অনেক পরিবার তাদের চাহিদায় কাটছাঁট করছে। এতে পুষ্টিতে টান পড়ছে। আবার অনেকেই আগের সঞ্চয় ভেঙে সংসারের খরচ মেটাচ্ছেন। আবার অনেকেই ধার-দেনা করে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। তবে সব ধরনের সেবার দাম বাড়লেও বাজার সিন্ডিকেটের কারসাজি বন্ধ হলে অন্তত নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে ‘হাঁসফাঁস’ অবস্থার সৃষ্টি হতো না সাধারণ ক্রেতাদের।
নিত্যপণ্য কিনতে আসা দিনমজুর আব্দুস ছালাম বলেন, নিত্যপণ্যের যেভাবে দাম বাড়ছে আর আমি যে কয়টাকা আয় করছি, তা দিয়ে এখন আমি সব খরচ বহন করতে পারছি না। বেঁচে থাকতে প্রয়োজনীয় খাবার রান্না ছাড়া কোনো ধরনের ভালো-মন্দ খাবার জুটছে না। পরিস্থিতি এমন-জীবনযাপন করতেই এখন খুব কষ্ট হচ্ছে।
নিত্যপণ্য কিনতে আসা আরেক ক্রেতা সাজিত হোসাইন সাজ্জাত বলেন, বাজারে নিত্যপণ্যের হঠাৎ এমন দাম বৃদ্ধিতে জীবনযাপন করতেই এখন খুব কষ্ট হচ্ছে। মৌসুমে শীতকালীন সবজির দাম কম হওয়ার কথা, কিন্তু বাজারের চিত্র ভিন্ন। জরুরি ভাবে নিত্য পণ্যের লাগামহীন দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
সামাজিক সংগঠন স্বপ্নের আলো ফাউন্ডেশন এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মো. নাঈম হাসান ঈমন নামে এক সমাজসেবক বলেন, প্রতিবছর প্রতিটি পণ্যের দাম অসহনীয়ভাবে বাড়ছে। কিন্তু সেভাবে ক্রেতাদের আয় বাড়ছে না। আয় না বাড়ায় ক্রেতারা বাড়তি দামে পণ্য কেনা এখন সবচেয়ে বড় চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক ক্রেতা অপরিহার্য পণ্য ছাড়া অন্যকিছু কেনা বাদ দিয়েছেন। অনেক মধ্যবিত্ত ও নিম্ন বিত্ত পরিবার খাবারের বাজেট কমিয়ে দিয়েছে। যে কারণে শরীরে পুষ্টি ঘাটতিও দেখা দিচ্ছে।
তিনি আরও জানান, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বাজারে নজর না থাকায় পণ্যের দাম বাড়তি রেখে অসাধুরা ভোক্তার পকেট কাটছে। কিন্তু দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হচ্ছে না। তাই অসাধুরা বারবার ক্রেতাদেরকে জিম্মি করে অতি মুনাফা করছে।
বাজার ঘুরে বিক্রেতাদের সাথে কথা বললে তারা জানায়, তাদের কিনতে হয় বেশি দামে, ফলে কম দামে বিক্রি অসম্ভব। তাহলে তাদের লাভের অংশ থাকে না। বাজারে নিত্যপণ্যের হঠাৎ এমন দাম বৃদ্ধিতে চরম অসন্তোষ প্রকাশ করছেন ক্রেতারা।
এবিষয়ে ঝালকাঠি জেলা প্রসাশক ফারাহ গুল নিঝুম জানান, বাজার নিয়ন্ত্রণে আমাদের অভিযান অব্যহত আছে এবং নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চলছে।